বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলন ও ২৩ মে নিয়ে কিছু কথা (পর্ব-১) - কাঞ্চনবরণ সিংহ

বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলন
ভূমিকা : 

ভারতের ভাষানীতির মূল ভিত্তি বলে খ্যাত, ১৯০৩ সালে প্রকাশিত স্যার গ্রীয়ার্সনের লিংগুইসটিক সার্ভে অফ ইণ্ডিয়া গ্রন্থের Vol 5, Part I, page 419 এ  “ময়াং” বা “বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী” ভাষার অস্তিত্ত মণিপুর রাজ্যে স্পষ্ট উল্লেখ করেন। এর আগে ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত মেজর মেককুলাচ Account of the Valley of Munnipore গ্রন্থে ময়াং-দের ভাষা সংরক্ষণ শুরু করেন। মণিপুরের সর্বজনগ্রাহ্য “চৈথারণ কুম্পাপা” গ্রন্থে ময়াং-দের উপস্থিতি সম্পর্কে বলা হয়েছে এরা নবম শতাব্দী থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত মণিপুরে প্রভাবশালী ছিল। এই “ময়াং” বা “বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী”-রা পার্শ্ববর্তী বার্মিসদের (মান) মণিপুর আক্রমণের সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক অন্তরকলহে জর্জরিত মাতৃভূমি মণিপুর থেকে পলায়ন করে পার্শ্ববর্তী কাছাড় রাজ্য ও শ্রীহট্টের জনবিহীন জলাশয় ও বনাঞ্চলে বসতী স্থাপন করে। আর একটি অংশ ব্রহ্মদেশে (তৎকালীন কাছাড় রাজ্যের লুসাই পাহাড়ের পাদদেশে) পলায়ন করে। ক্রমান্বয়ে ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়ে উঠলে, ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠন প্রক্রিয়ায় স্বাধীন ভারতের রাজ্যগুলো সংগঠিত হয়। ততদিনে মণিপুরে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা ব্যবহারকারীরা লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা মণিপুরী (মৈতেই) ভাষাকে জীবিকার প্রয়োজনে ঘরে ও বাহিরে সমানভাবে গ্রহণ করে ফেলে। ফল  বর্তমানে মণিপুরে এই ভাষা ব্যবহারকারী নেই বললেই চলে। অন্যদিকে আধুনিক চেতনা সঞ্চিত হয়ে আসাম ও ত্রিপুরায় বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি আদায়ের সংগ্রাম শুরু করে। এই দাবী আদায়ের সংগ্রামে অনেক ওঠা-নামা লাঞ্ছনা-বঞ্চনা অত্যাচার-নিগ্রহের পথ পেড়িয়ে ত্রিপুরার বামফ্রন্ট সরকার ১৯৯৫ ইংরেজির ২৩ মে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের দাবী মাতৃভাষাকে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় চালু করেন। আর এভাবেই স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা স্ব-প্রতিষ্ঠিত হয়। পরের বছর ১৯৯৬ ইংরেজির ১৬ মার্চ আসামের করিমগঞ্জ জেলার কলকলিঘাট রেল স্টেশনে ভাষার দাবীতে ৫০১ ঘন্টার রেল অবরোধ আন্দোলনে পাথারকান্দির কচুবাড়ি গ্রামের তরুণী সুদেষ্ণা সিংহ শহিদবরণ করেন এবং ২০০১ এর ১২ ফেব্রুয়ারি আসামেও এই ভাষা প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে চালু হয়।      

❒  ভাষার চিন্তা : ব্রিটিশ ভারতে

বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের মধ্যে থেকে ভাষা নিয়ে যিনি প্রথম চিন্তা-চর্চা শুরু করেন তিনি মাছুঘাট গ্রামের শিক্ষিত যুবক হরিদাস সিংহ। পরবর্তীতে তিনি আসামের এ.সি.এস. অফিসার হয়েছিলেন। তিনি “বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষা” নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন ১৯৩৩ সালের প্রকাশিত মণিপরী পত্রিকার ১ম বর্ষ ৩য় সংখ্যায়। তিনি মণিপুরীদের বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষার ব্যাকরণ-চিন্তা  নিয়ে বিস্তারিত লেখেন। সেই থেকে কষ্টার্জিত  মৈতেই ভাষা ছেড়ে দিয়ে বিষ্ণুপ্রিয়ারা নিজ মাতৃভাষার বিকাশ নিয়ে চিন্তা-চর্চা শুরু করেন।

❒  স্বাধীন ভারতের সংবিধান ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা :

ভারতের স্বাধীনতার প্রাক-মূহূর্তে করিমগঞ্জ কলেজের প্রথম নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক গোপী মুখার্জি, কাছাড় সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরিষদেরও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এই সংগঠনের সাথে সংযোগ ছিল কলকাতার “প্রগতিশীল লেখক সংঘে”র। আবার এই প্রগতিশীল লেখক সংঘের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল ফ্যাসিবাদ বিরোধী ফরাসী দেশের “প্রগতি লেখক  সংঘে”র। এইসব তথ্য পাওয়া যায় কাছাড় সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরিষদের হাতে লেখা মুখপত্র ভাবী পত্রিকায়। এই ভাবী পত্রিকায় চর্চা শুরু হয় স্বাধীনোত্তর ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠন প্রক্রিয়ার ও সংখ্যালঘু ভাষাদের উপর সংখ্যাগুরু ভাষাদের ক্ষমতা প্রদর্শনের লড়াই-এর বিষয়ে। সময়টা ১৯৪৬-৪৮। তখনো ভারতবর্ষে চলছে সংবিধান প্রণয়নের কাজ। ছাত্র-সংগঠক গোপী মুখার্জি সেই লব্ধ চেতনা থেকেই ভাষা-সংখ্যালঘু বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের ভাষা নিয়ে চিন্তা  শুরু  করেন। সংখ্যাগুরুদের দাপটে ভাষিক সংখ্যালঘুরা যে আগামী দিনগুলোতে বিপদাপন্ন হবেন তা আন্দাজ করে নেন এবং পরবর্তীতে দেশে সংবিধান প্রবর্তিত হলে সংবিধানে উল্লেখ ধারা ৩৫০ (A) র মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণের মৌলিক অধিকারের বিষয় নিয়ে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী জনসমাজকে সচেতন করতে শুরু করেন। তারই ফলস্বরূপ ১৯৫১ এর এন.আর.সি. এর নথিপত্রে আনিপুর-দুল্লভছড়া অঞ্চলের মানুষ সমীক্ষা পত্রের ৯ নং কলামে জাতি “ক্ষত্রিয় মণিপুরী” এবং মাতৃভাষার ১৩ নং কলামে মাতৃভাষা “বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী” বা “বিষ্ণুপ্রিয়া” লিপিবদ্ধ করান। কিন্তু বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী অধ্যুষিত অন্যান্য অঞ্চলগুলোতে মানুষের এই ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে সচেতনার অভাবে ১৩ নং কলামে  মাতৃভাষা “মণিপুরী” লেখান।

ভাষা শহীদ সুদেষ্ণা সিংহ (প্রতীকী ছবি - অন্তর হালদার)

 ❒   বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষায় শিক্ষার দাবি :  

ভারত স্বাধীন হওয়ার পর তরুণ গোপী মুখার্জি মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকারের দাবী উত্থাপন করেন। তিনি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী নেতৃবৃন্দকে ডেকে নিজ অঞ্চলে  বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের সর্বোচ্চ সামাজিক সংস্থা নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী মহাসভার অধিবেশন আয়োজন করেন এবং মহাসভার অভ্যর্থনা সমিতির সম্পাদকের দায়িত্ব নিজ হাতে পালন করেন। দীর্ঘ ১৩ বছর পর সেই মহাসভার অধিবেশন বসে এবং আধুনিক গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে নতুনভাবে পরিচালিত হতে শুরু করে। এই মহাসভায় সার্বজনীন ভাবে সরকারের কাছে ভাষা দাবীর সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। এবং আরো কয়েকটি যুগান্তরকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

❒  জাতীয় সংগঠন মহাসভা ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা কমিটি :

প্রায় ১৩ বছর পর ১৯৫৫ সালে মহাসভার পুনর্জাগরণ ঘটে গোপী মুখার্জির হাত ধরে এবং আধুনিক গণতান্ত্রিক রূপ ধারণ করে। ঐতিহাসিক সেই ১৪শ আন্দুরগাঙ অধিবেশনে আলোচ্য বিষয়ের প্রথম স্থান পেয়ে যায় মাতৃভাষা, গোপী মুখার্জির সৌজন্যে। যে ধর্ম নিয়ে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের পরম্পরাগত দাসত্ব, আলোচনায় তার স্থান দেওয়া হয় ৮ম। সেই অধিবেশনে মাতৃভাষা ভিন্ন এমনকি ধর্ম নিয়েও আলোচনা হয়নি। সেই অধিবেশনে গঠন করা হয় বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ এবং সংরক্ষণের জন্য বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সাহিত্য পরিষদ, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা কমিটি, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী অর্থনৈতিক কমিটি এবং মহাসভার  কার্যকরী  কমিটি। ভাষা কমিটি এবং মহাসভা কার্যকরী কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয় তরুণ গোপী মুখার্জিকে।

 ❒  বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা দাবি পরিষদ গঠন :

১৪ জুন ১৯৬১ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা পরিষদ এবং সাহিত্য পরিষদ যৌথভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ২রা জুলাই ভাষা দাবী দিবস পালনের। ২৯ আগষ্ট ১৯৬১ সালে সাহিত্য পরিষদের সম্পাদক মদন মুখার্জি এবং সমরেন্দ্র সিংহের নেতৃত্ব একটি প্রতিনিধি দল শিলঙে আসামের মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চালিহার সাথে প্রথমবার গিয়ে সাক্ষাৎ করেন ও মেমোরেণ্ডাম প্রদান করেন। অবশ্য তার ফল কিছুই হয়নি। তারপর ১৯৬২ সালে ভাষা পরিষদ, ভাষা দাবী পরিষদে রূপান্তরিত হয়।  

১৯ শে মে বাংলা ভাষা আন্দোলন এবং বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী নেতৃবৃন্দ:

১৯৬০ সালে আসাম বিধানসভায় রাজ্যভাষা বিল পাশ হয়। সেখানে গৃহীত হয় আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা অসমীয়া। রাজ্যভাষা আইনের বিপরীতে দাঁড়িয়ে বরাক উপত্যকার বাংলাভাষা প্রেমীরা আন্দোলন সংগঠিত করে। এই আন্দোলনের প্রস্তুতিপর্বে রাতাবাড়িতে গোপী মুখার্জি, চান্দবাবু সিংহ, মদন মুখার্জি, ভারত মুখার্জি প্রমুখের নেতৃত্বে; পাথারকান্দিতে শম্ভু সিংহ, নরেন্দ্র সিংহ, কুশধ্বজ সিংহ প্রমুখ; করিমগঞ্জে যুবনেতা ভূপেন্দ্র (মণি) সিংহের নেতৃত্বে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা প্রত্যক্ষভাবে আন্দোলনে জড়িত হয়ে পড়েন এবং গ্রামে গ্রামে ঘুরে ভাষা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু বাংলা ভাষার দাবীর স্বপক্ষে থেকে কাজ যান। ১৮ এপ্রিল ১৯৬১ ইংরেজি পাথারকান্দিতে সমরজিৎ সিংহের সভাপতিত্বে নি. বি. ম. মহাসভার এক জরুরি সভায়, কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্তের প্রতি সর্বসম্মতিক্রমে সমর্থন জানিয়ে প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং সংখ্যালঘু বাংলা ভাষার দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলনে সক্রিয় সহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯ এপ্রিল ১৯৬১ করিমগঞ্জ শহর থেকে পথ পরিক্রমা শুরু করে ভাষাপ্রেমী পদযাত্রীরা। ২১ এপ্রিল সেই পদযাত্রীদের নিয়ে পাথারকান্দিতে এক বিরাট জনসভা আয়োজিত হয় সেখানে সভাপতিত্ব করেন নরেন্দ্র সিংহ। ২২ এপ্রিল আনিপুরে পদযাত্রীরা এসে পৌছলে গোপী মুখার্জির দাদা ভারত মুখার্জির সভাপতিত্বে  আরো এক বিরাট  জনসভা  অনুষ্ঠিত হয়। তদ্রূপ ২৩ এপ্রিল নিশিকান্ত সিংহের সভাপতিত্বে দুল্লভছড়ায় অনুষ্ঠিত হয় আর একটি বিশাল জনসভা । এইভাবে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী অঞ্চলগুলোতেও আন্দোলনের প্রস্তুতি চলে।  অবশেষে ১৯ মে বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ের সংগ্রামে শিলচর রেলস্টেশনে ১১ জন সত্যাগ্রহী ভাষাপ্রেমী শহিদবরণ করেন। সেই দিন পাথারকান্দিতে বন্দী হন শম্ভু সিংহ, নরেন্দ্র সিংহ, যুবনেতা কুশধ্বজ সিংহ প্রমুখ। সেইদিন পাথারকান্দি, রাতাবাড়ি, দুল্লভছড়ায় রেলের চাকা একদম হেলেনি।

প্রতিক্রিয়া :

কাছাড় জেলা কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত অনুসারে বাংলা ভাষা আন্দোলনের স্বপক্ষে দাঁড়িয়ে অন্যান্যদের সাথে আসাম বিধানসভায় সদস্যপদ ত্যাগ করেন তৎকালীন শিলচরের বিধায়ক নন্দকিশোর সিংহ ও পাথারকান্দি আঞ্চলিক পঞ্চায়েত সহ-সভাপতি গোলাপ সিংহ।

আরাকউ লেখা তামকরিক..........

মাদৈ - সরারেলর ৱারি - প্রতাপ সিংহ লেখক: প্রতাপ সিংহ

সেন্সাস চক্রান্ত ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের প্রতিবাদ কর্মসূচি :

১৯৬০ এর ২রা জানুয়ারি শিলচরে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা পরিষদ, ১৯৬১ তে অনুষ্ঠিতব্য ভাষা ভিত্তিক জন গণনায় “মণিপুরী” জাতিকে--- “মেইতেই” এবং “বিষ্ণুপ্রিয়া” দুই ভাগে ভাগ করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানায়। কিন্তু সরকার বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের কথায় কর্ণপাত করেনি। ফলস্বরূপ ১৯৬১ এর লোকগণনার তথ্যে বিরাট অসঙ্গতি থেকে যায়। সেটা ছিল সরকারের জেনে-শুনে করা একটি চক্রান্ত। দেখানো হয় জনবহুল পাথারকান্দি অঞ্চলে একজন মাত্র বিষ্ণুপ্রিয়া লোকের অস্তিত্ব। তাও মহিলা। পরের পৃষ্ঠায় বিভিন্ন তথ্যের তুলনামূলক তালিকাটি দেখলেই অনেক কিছুই অনুমান করা যায়।

মণিপুরি সেন্সাস রিপোর্ট

▶ ১৯৫১ তে সারা ভারতবর্ষে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী জনসংখ্যা দেখানো হয় ১১৪। সবাই মণিপুরের।  অথচ স্যার জী. এ. গ্রীয়ার্সন প্রায় ৬০ বছর আগে ১৮৯১ ইংরেজিতেই দেখিয়ে গেছেন ভারতের মণিপুরে প্রায় ১০০০ জন ও অসমের শ্রীহট্ট জেলায় প্রায় ২৩,৫০০ জন বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীর অস্তিত্ব। ১৮৮১ এর সেন্সাস রিপোর্টে দেখানো হয় শ্রীহট্টে ৭৪ জন (২৪০৫১ জন ক্ষত্রিয় মণিপুরী) ও কাছাড় জেলায় ২ জন (১৩২৩৭ জন ক্ষত্রিয় মণিপুরী) বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী লোক। (খুব সম্ভব মনে হয় ১৮৮১ তে অধিকাংশ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা নিজেদের “ক্ষত্রিয় মণিপুরী” বলে পরিচয় প্রদান করে, সেখানে উল্লেখ আছে কাছাড়ে ১৩২৩৭ ও শ্রীহট্টে ২৪০৫১ জন ক্ষত্রিয় মণিপুরী । কারণ আমরা দেখতে পাই যে প্রায় ৭০ বছর পরও ১৯৫১ এর এন.আর.সি.-র সমীক্ষার নথিপত্রে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা ৯নং কলামে জাতি “ক্ষত্রিয় মণিপুরী” লেখান। তাই মনে হয় ১৮৮১ এর ক্ষত্রিয় মণিপুরীদের একটি বড় অংশ নিশ্চয় বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষী লোক ছিল।) স্বাধীন ভারতের প্রথম এন.আর.সি-র তথ্য সংগ্রহের নথিগুলোতেও (১৯৫১ সালে), আসামের তৎকালীন কাছাড় জেলার করিমগঞ্জ মহকুমার রাতাবাড়ি থানাধীন মাত্র চার-পাঁচটি গ্রামে, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষিক জনগণের সংখ্যা প্রায় হাজার-অধিক উল্লেখ আছে। উল্লেখ্য, এই রাতাবাড়ি অঞ্চলে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী গ্রামের সংখ্যা প্রায় ৪০ টি। সুতরাং তাতেই প্রমাণিত হয় ১৯৬১ এর সেন্সাস ভুল তথ্যে ভরা ছিল।

▶ ১৯৬১ এর সেন্সাস রিপোর্টে দেখানো হয় আসামের করিমগঞ্জ জেলার বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী অধ্যুষিত অঞ্চল পাথারকান্দিতে ১ জন লোকের অস্তিত্ব। তাও একজন মহিলার। আবার ত্রিপুরায় দেখানো হয় ১৩ জন লোকের অস্তিত্ব। সেখানে আবার সবাই পুরুষ।  বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা পরিষদ ১৯৬৭ সালে একটি নিজস্ব সেন্সাস করে সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। সেই সেন্সাস মতে কাছাড়ের তিনটি সাব-ডিভিসন শিলচর, হাইলাকান্দি ও করিমগঞ্জ সবমিলিয়ে ১৪৬ টি গ্রামে জনসংখ্যা প্রায় ৬৬,৬২৩। আর পাথারকান্দিতেই ২২০০০ লোক। যেখানে সেন্সাস ১ জন লোক দেখিয়েছিল।  

▶ ১৯৭১ সালে দেখানো হয় পাথারকান্দিতে ১০১৬৪ জন বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষী। অর্থাৎ ১৯৬১ সালের ১ জন মহিলা দশ বৎসরে এত সব লোকের জন্ম দিয়েছেন ! আবার ত্রিপুরায় দেখানো হয় ৯৮৮৪ জন বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষী। অর্থাৎ ১৯৬১ সালে দেখানো ১৩ জন পুরুষ দশ বৎসরে কোনো মহিলা  ছাড়াই এত লোকের  জন্ম  দিয়েছেন! এ কি সম্ভব? যুক্তিযুক্ত? এর থেকেই প্রমাণিত হয় ১৯৬১ সালের ভাষাভিত্তিক জনগণনা ছিল আসলে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের নিয়ে একটি বিরাট ষড়যন্ত্র।

▶ ভাষার নামাকরণ নিয়েও বিতর্ক ছড়িয়ে দেয় সেন্সাস কর্তৃপক্ষ। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা নিজের ভাষাটির নাম স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করে “বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী” বলে। ১৯৫১ এর মণিপুর সেন্সাস এ নামটি লিপিবদ্ধ ছিল বিষ্ণুপ্রিয়া বলে। ১৯৬১ ও ১৯৭১ এর সেন্সাসে মণিপুর, আসাম ও ত্রিপুরায় কোনো এক অজ্ঞাত কারণে বিষ্ণুপ্রিয়া’র বদলে “বিষ্ণুপুরিয়া” লিপিবদ্ধ হয়। তাই সেন্সাস ডাটাগুলোতে “বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী” নামটি বিকৃত হয়ে কখনো “বিষ্ণুপুরিয়া” বা “বিষ্ণুপুরিয়া মণিপুরী” বলে উল্লেখ আছে। এই বিকৃতির শুদ্ধীকরণ করার জন্যর আবেদন নিবেদনের মাধ্যমে সেন্সাস কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। কিন্তু আজও তার ফল মেলেনি।   

বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের মধ্যে থেকে কেহ বা যদি ভাষার নাম “বিষ্ণুপ্রিয়া” বলে থাকে, তাহলে “বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী”দের ১সাব-গ্রুপ হিসাবে “বিষ্ণুপ্রিয়া” লেখার কথা। কিন্তু তার বদলে সেন্সাস অথোরিটি “বিষ্ণুপ্রিয়া”দের সাব-গ্রুপ “বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী” বলে ষড়যন্ত্রমূলক তথ্য মুদ্রিত করে।  “বিষ্ণুপ্রিয়া”দের সাথে “বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী”রা মিলিত হয়ে গেছে, সেই কারণ দেখিয়ে সঠিক বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী জনসংখ্যা ১৯৯১ সাল অবদি জানা সম্ভব হয় না। এইভাবে ষড়যন্ত্রমূলক ভুল নাম মুদ্রিত ও তথ্য পরিবেশনের প্রতিবাদে মহাসভার নেতৃত্বে ১৯৮১ তেই সরকারের কাছে এর স্পষ্টীকরণ দাবী করে ।  এদিকে Census of India 1981, Series 21, Tripura গ্রন্থের ৫২ পৃষ্টায় লেখা হয় যে নমেনক্লেচারের সিদ্ধান্ত ঠিক না হওয়ার জন্য বিষ্ণুপুরিয়া/ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অথচ সেন্সাস কর্তৃপক্ষ থেকে ১৯৮১ তেই বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের নামে আলাদা “কোড অফ স্ট্রাকচার” দেওয়া হয়।   

আসলে, রাষ্ট্র এই অদ্ভুত ষড়যন্ত্রমূলক বিকৃত তথ্য পরিবেশন করে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের ন্যায্য দাবীকে উপেক্ষা করতে চেয়েছিল। রাষ্ট্রের এই দায়-দায়িত্ব কাণ্ডজ্ঞানহীন অভিপ্রায়কে প্রত্যাহ্বান জানিয়ে শুরু হল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের আন্দোলন; মাতৃভাষার জন্য  আন্দোলন,  গণতান্ত্রিক পথ মেনেই।

 প্রতিবাদ কর্মসূচি হাতে নিয়ে ৬১-এর সেন্সাস-এর প্রতিলিপি জ্বালিয়ে দিয়ে প্রতীকীভাবে এ অন্যায়ের প্রতিবাদ জানানো হয়। ১৯৭২ সালে মহাসভা, ছাত্র সংস্থা ও আন্দোলন পরিষদের যৌথ উদ্যোগে পদযাত্রা সংগঠিত করে।

 ❒  ২রা জুলাই ১৯৬১ : বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা দাবি দিবস উদযাপন :

“মণিপুরী” তথ্য সম্পর্কীত আসাম সরকারের সার্কুলার নং 652758 Dated 16/5/1961 এর “বিষ্ণুপ্রিয়া” ও “মৈতৈ”---- এই দুই ভাষার স্পষ্ট উল্লেখের ভিত্তিতে, সার্কুলারের সংশোধিত রূপের জন্য, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা পরিষদ সরকারের নিকট দাবী তুলে। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা পরিষদ  ২ জুলাই ১৯৬১ “ভাষা দাবী দিবস” পালন করে সমগ্র বরাক উপত্যকা জোড়ে। সেই বৎসর শিলঙে আসাম সরকারের সাথে ভাষা পরিষদের প্রতিনিধিবর্গ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের দাবী-দাওয়া সম্পর্কে আলোচনায় বসেন এবং দাবী পূরণের আশ্বাস নিয়ে প্রত্যাবর্তন করেন। সেই থেকেই প্রতি বৎসর বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা “২রা জুলাই ভাষা দাবী দিবস” হিসাবে পালন করে। ১৯৬৩ তে দাবী দিবস পালনের প্রেক্ষিতে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের দাবী আসাম সরকারের শিক্ষা বিভাগের বিবেচনাধীন বলিয়া এক পত্রে ( Vide C.M.S. 18/63 dated 25.7.63) ঘোষণা করে। একই বৎসর ১১ অক্টোবর অ্যাসিস্টান্ট কমিশনার ফর লিঙ্গুইসটিক মাইনোরিটি-র আহ্বানে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী প্রতিনিধিবর্গ শিলচরে সাক্ষাৎ করেন। ১৯৬৪ তে ২রা জুলাই এক সপ্তাহ ব্যাপী “ভাষা দাবী সপ্তাহ” বিভিন্ন স্থানে বিরাট জন সমাবেশে পালন করা হয়। দাবী সপ্তাহ পালনের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ আসাম সরকার এক পত্রের মাধ্যমে বিষয়টি রাজনৈতিক বিভাগের বিবেচনাধীন বলে জানান। “বিবেচনাধীন” শব্দের বেড়াজালে যখন ন্যায়সংগত দাবী-দাওয়া আবদ্ধ, তখন ১৯৬৫ তে ব্যাপক গণআন্দোলন প্রস্তুতির ভিত্তিতে ২-১২ জুলাই ১০ দিন ব্যাপী পালন করা হয় সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য আবেদনপত্র দাখিল করা হয় । ১২/৭/১৯৬৫ ভারত সরকারের সহকারী সংখ্যালঘু কমিশনার দাবী দিবস পালনের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ  এক পত্রের মাধ্যমে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে চালু করার বিষয়ে আসাম সরকারের স্বীকৃতির কথা ঘোষণা করেন।  কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে আসাম সরকারের নিষ্ক্রিয়তা আন্দোলনের পথে একটা সমাজকে নিয়ে যেতে বাধ্য করে। সংগ্রামের আওয়াজ সমাজের হৃদয় মূল থেকে ধ্বনিত হতে থাকে। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সহকারী ভাষা কমিশনারের আমন্ত্রণে ভাষা পরিষদ ও সাহিত্য পরিষদের যৌথ প্রতিনিধিদল ৯ মে ১৯৬৬ শিলচরে সাক্ষাৎ করলে, তিনি প্রতিনিধিবর্গকে আসাম রাজ্যিক প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ডের সম্পাদকের সাথে বসার পরামর্শ দেন। সেই মতে ১৯ মে রাজধানী শিলঙে আলোচনায় বসা হয়। সেই সাক্ষাৎকারের ফলস্বরূপ ১৯৬৭ সালে কাছাড়ে ৬৫ টি স্কুলে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা চালু ঘোষিত হয়। বর্তমানেও ভাষা স্বীকৃতির পর, ২রা জুলাই দিনটিকে স্মরণে রেখে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের অন্যান্য বিভিন্ন দাবী-দাওয়া আদায়ের জন্য “দাবী দিবস” হিসাবে পালন করেন।

(আগামি সংখ্যায় পর্ব-২ ও অন্তিম পর্ব প্রকাশিত হবে)

লেখক,
কাঞ্চনবরণ সিংহ
কবি, সাহিত্যিক ও গবেষক

0 Comment "বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলন ও ২৩ মে নিয়ে কিছু কথা (পর্ব-১) - কাঞ্চনবরণ সিংহ"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন