শ্রীকৃষ্ণই রাসের শ্রীমূতি-নির্মল এস পলাশ

শ্রীকৃষ্ণই রাসের শ্রীমূতি

বাংলাদেশে নৃ-তাত্ত্বিক মণিপুরী জনগোষ্ঠী বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির ধারক ও বাহক।   ধ্রুপদী নৃত্য ও ঐতিহ্যময় সংস্কৃতির কারণে মণিপুরী জাতি আজ সু-পরিচিত।   রাসলীলার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও নান্দনিক নৃত্যশৈলী দর্শন করে বিমুগ্ধ হয়েছিলেন, প্রম চাঁদে গমণকারী নীল আমস্ট্রং ও ভারতের মহাত্মা গান্ধী।   একইভাবে পুলকিত হয়েছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৯ শ্রীহট্ট ভ্রমণকালে সিলেট মাছিমপুর গ্রামে।   মণিপুরী সমাজে রাসলীলার এই উৎসব শুরু হয়েছিল মশালহারিকেনের আলোয়: আজ তা পুরোটাই আধুনিক সাজসজ্জায় বিদ্যুতের আলোকিত হয়ে আলোকচ্ছটা ছড়াচ্ছে।   লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগমে দিবারাত যেন সমুদ্রে বহমান ভক্তদের স্রোতধারা।   শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা দর্শনে আসেন সবাই ভক্তি ও শ্রদ্ধার সহিত।   কার্তিকের চাঁদগলে জ্যোৎনা যখন মাতাল করে রাখে প্রকৃতিকে, শিশির-ঘাসে অপূর্ব মাখামাখি চলে যখন মোহন মুগ্ধতায় তখনই আসে রাসপূর্ণিমা, কার্তিক মাসের অথবা তিথির বিস্তৃতি অনুসারে অগ্রহায়ন মাসের পবিত্র পূর্ণিমা তিথিতে বিশেষ সময়কে ধারণ করে।   অর্থাৎ চন্দ্র যেদিন পূর্ণকলায় বিকশিত হবে সেই দিনই মহারাসলীলা, ইতিহাস জানায় রাজর্ষি ভাগ্যচন্দ্র বিখ্যাত রাসনৃত্যের প্রবর্তক।
রাজর্ষি ভাগ্যচন্দ্র যখন মণিপুরের সিংহাসনে অসীন, তখন শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মেও জোয়ারে মণিপুর তখন প্লাবিত বৈষ্ণব প্রেম ভক্তিবাদে অনুসারীরা মণিপুরের প্রান্তরে প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়ে মানুষকে যখন কৃষ্ণপ্রেমের দিকে আকৃষ্ট করেছেন, প্রেমভক্তিবাদে এমনি এক মহাপ্লাবনের সময় রাজর্ষি ভাগ্যচন্দ্র স্বপ্নদৃষ্ট হয়ে রাসলীলা আয়োজন করেন।   দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত রাসলীলা।   একটি হল রাস, অপরটি লীলা।   চিত্তে সত্ত্বভাবের উদয় হলে যে অপূর্ব অখন্ড চমৎকার আনন্দ উদিত হয়: যাতে রজ: ও তমোগুণের স্পর্শ নাই এবং ব্রহ্মানন্দের তুল্য: তাই রাস।   এই রস হইতে রাস শব্দ এসেছে।   লীলা হল সাত্ত্বিক বা ত্রিগুণাতীত কর্মাদী।   যে কর্মে ইন্দ্রিয়ের সুখ নেই, কেবল আত্মিক সুখ আছে: এমন কর্মাদী লীলা শ্রীকৃষ্ণ হলেন রসের আধার।   বৃন্দাবনে রাধা ও গোপীদের সাথে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সচ্চিদান্দময়ী যে ভবলীলা করেছিলেন তাই রাসলীলা।   যমুনাপুলিন মহারাসস্থল।   আকাশে শরদ রজনীতে পূর্ণিমার পূর্ণচন্দ্র উদিত।   পূর্ণিমার চন্দ্রিমায় কিরণে যমুনাপুলিন অপরূপ রূপে সুবাসিত।   চন্দ্রের কিরণে বৃক্ষ-তরুলতা আলোকিত।   চন্দ্রের কিরণ উপচে পড়েছে যমুনার জলে।   যমুনা উৎফুল্ল হৃদয়ে চন্দ্রের কিরণ বক্ষে ধারণ করেছে।   তাই যমুনা উদ্বেলিত, উদ্ভাসিত ও আনন্দিত।   মাধবী, মালতী, শেফালি, মল্লিকা, অশোক, চম্পক, গোলাপ, বকুল, পারিজাত ইত্যাদি নানা জাতিপুষ্প প্রস্ফুটিত, বিকশিত ও প্রফুল্লিত।   ময়ুর-ময়ুরী ছন্দে নৃত্যরত।   কোকিলা পঞ্চমসুরে গীতরত।   বৃন্দাবনের যমুনাপুলিনে পূর্ণিমার অবারিত জোৎনায় মগ্ন নির্জন রাতে ব্রজবালাদের নিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার মধুর রাসলীলা করেছিলেন।  রাসলীলা বা রাসনৃত্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ঐতিহ্যময় লীলার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা অমল পুরাণের দশম স্কন্ধে বিশদভাবে বর্ণিত রয়েছে।   অমল পূরাণ মতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রেমময়ী লীলা উপভোগের অভিলাস এবং ব্রজগোপীদের অপ্রাকৃত কৃষ্ণপ্রেম ও মিলন রাসনৃত্যের উদ্দেশ্যে।   রাসলীলা গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের কৃষ্ণপ্রেম-প্রীতির ঐতিহ্য দর্শন।   অখিলরস্যমৃতমূর্তি শ্রীগোবিন্দের অপার লীলা বারিধিতে শ্রীশ্রী রাসলীলা হল সর্বশ্রেষ্ঠ লীলা।   গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনে রাসকে বলা হয় “লীলামুকুটমণি”।   অমল পুরাণে শ্রীমদ্ভাগবতের রাস পঞ্চাধ্যায়কে ভাগবতরূপী শ্রীকৃষ্ণের পঞ্চপ্রাণস্বরূপ বলা হয়।   প্রেম রস আস্বাদনের মাধ্যমে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং আন্দোলিত হয়ে ভক্তকূলের প্রেমান্দকে অতি চৈতন্যলোকে প্রবাহিত করে ইশ্বরের দিকে কেন্দ্রীভূতি করা এবং জীব-জগতে এর বিস্তার ঘঠানোর লক্ষে তিনি যে লীলায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন তাই তার নামই রাস।   ভক্তিপ্রেম রস থেকে রাস।   শ্রীকৃষ্ণই রাসের শ্রীমূর্তি।   দ্বাপরযুগে ভারতের উত্তর প্রদেশের মথুরা জেলায় অবস্থিত প্রেমভক্তিলীলার আধ্যাত্মিক তীর্থক্ষেত্র বৃন্দাবনের যমুনা পুলিনে পুষ্পপত্রে সুশোভিত পূর্ণিমায় অবারিত জ্যোৎনায় বিমুগ্ধ নির্জনে নিস্তব্ধ গভীর রাতে নিত্যসিদ্ধা ও সাধনসিদ্ধা ব্রজবালাদের নিয়ে লীলা পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ রাসলীলা করেছিলেন।   রাসলীলা শ্রীকৃষ্ণের লীলা বিশেষ সেই অনাদিকাল থেকে রাসলীলা হয়ে আসছে।   অনন্তকাল ধরে তার লীলা থাকবে।   মণিপুরীরা শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলানুসরণ করে আসছে।   মণিপুরীরা যে রাসলীলা অনুসরণ করে আসছে তা বিশ্বে অনন্য।   ভারতে বিধানসভাতে (১৯৬৫) মণিপুরী রাসলীলাকে অনন্য হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়ছে।   রাসপূর্ণিমার আগে থেকেই মণিপুরী সমাজে এ উৎসবে আমেজের ছোঁয়া লেগে যায়, রাসলীলা মণিপুরীদের প্রধান বাৎসরিক ধর্মীয় উৎসব হলেও এ উৎসকে কেন্দ্র করে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের অংশগ্রহণে তা আজ সার্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে।   দেশের নানা প্রান্ত থেকে সংষ্কৃতি অনুরাগী, ভক্তবৃন্দ, সাংবাদিক, সাংষ্কৃতিক গবেষক, দেশী-বিদেশী পর্যটক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা আসেন, রাসলীলা উপভোগ করতে।   মৃদঙ্গের ছন্দে, তালে, বিলীন হয় বিভেদের সকল রেখা।   কয়েক লক্ষ লোকের সমাগমে রাত ও দিনব্যাপী পুরো অঞ্চল মুখরিত হয়ে উঠে।   রাসলীলার মাধ্যমে আমাদের প্রগতিশীলতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা চেতনা বৃদ্ধি পেয়ে সম্প্রীতির অটুট বন্ধন সুদৃঢ় করে চলেছে।   সকলের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে শ্রীশ্রী কৃষ্ণের মহারাসলীলা ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।   অমল পুরানে উল্লেখ্য আছে যে, যিনি শ্রদ্ধাম্বিত হয়ে রাসলীলা শ্রবণ বা বর্ণনা করেন, তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত প্রেম হৃদয়ে ধারণ করেন।   রাসলীলার এই শুভ তিথিতে সবার হৃদয়ে জাগিত হোক কৃষ্ণপ্রেম, প্রীতি ও ভালোবাসা। 

নির্মল এস পলাশ
মাধবপুর, কমলগঞ্জ, বাংলাদেশ।

0 Comment "শ্রীকৃষ্ণই রাসের শ্রীমূতি-নির্মল এস পলাশ"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন